হযরত আবুবকর (রাঃ) ও ইবনে দাগান
হযরত আবুবকর (রাঃ) ও ইবনে দাগান
প্রাক-ইসলামি যুগে হযরত আবুবকর (রাঃ) মক্কার কোরাইশ বংশে অত্যন্ত নামকরা ব্যক্তি ছিলেন। এই নাম-যশ-খ্যাতির পেছনে তাঁর দুটি বিশেষ জিনিস ছিল। একটি তাঁর অগাধ ধনসম্পদ ও অন্যটি তাঁর নিষ্কলুষ চরিত্র। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর নাম-যশ-খ্যাতি কমেনি, বরং বেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওপর বেড়ে গেল অন্যান্য কোরাইশদের ক্রোধ-রাগ-ঘৃণা ও বিদ্বেষ ইত্যাদি। যেহেতু তিনি নিজ ব্যক্তি প্রভাব ও তাঁর বিপুল অর্থ দ্বারা ইসলাম প্রচারে মনে- প্রাণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে আপন প্রভাবে প্রভাবান্বিত করে যেমন ইসলামের সুশীতল ছায়ায় দাখিল করেছিলেন তেমনি অনেক অসহায় গরিব মানুষকে, ক্রীতদাস-দাসীকে আপন অর্থের (৩০ হাজার
হযরত আবুবকর (রাঃ)-৮ স্বর্ণ মুদ্রার বিনিময়ে মুক্ত করে ইসলামে আসার সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছিলেন এই নানাবিধ কারণে মক্কার কোরাইশগণ আবুবকর (রাঃ)-এর ওপর অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েন। তাঁর ওপর অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে গেল। কোমল প্রাণ মহানবীর হৃদয় যেন কেঁদে উঠল আবুবকর (রাঃ)-এর ওপর অত্যাচার দেখে। তিনি তাঁকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার জন্যে নির্দেশ দিলেন। তাঁর মক্কা ত্যাগের বা মহানবীর সঙ্গত্যাগের মোটেই ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু মহানবীর নির্দেশ তিনি অমান্য করতে পারেন না। একদিকে মহানবীর আদেশ ও অন্যদিকে আপন মনের ইচ্ছা। এই দুটোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিল। অবশেষে মহানবীর আদেশকেই অন্তরের সাথে মেনে নিলেন আবিসিনিয়ার পথে যাত্রা করার জন্যে। আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে একদিন আবুবকর (রাঃ) আবিসিনিয়ার পথে যাত্রা করলেন। যখন তিনি ‘বারকল গাবাত’ নামক স্থানে পৌঁছালেন; তখন আকস্মিকভাবেই তাঁর সাথে দেখা হল মক্কার কাবা গোত্রের নেতা ইবনুল দাগানের সাথে। তখন ইবনুল দাগান আবুবকর (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কোথায় যাচ্ছেন। উত্তরে আবুবকর (রাঃ) জানালেন তাঁর সমস্ত দুঃখের কাহিনী। ইবনুল দাগান নিজেও ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, হৃদয়বান মানুষ। তিনি যেন আবুবকর (রাঃ)-এর মতো মহান ব্যক্তির দেশত্যাগকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। ইবনুল দাগান আবুবকর (রাঃ)-কে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বোঝাবার চেষ্টা করলেন তাঁর মতো মানুষের দেশত্যাগ করাটা ঠিক হবে না। কোরাইশগণ তাঁর প্রতি যে অত্যাচার করেছে, তা তারা একান্ত ভাবেই অন্যায় করেছে। তিনি বারবার আবুবকর (রাঃ)-কে কথা দিলেন, তিনি আবুবকর (রাঃ) ও কোরাইশদের মধ্যে একটি বোঝাপড়া করে দেবেন যাতে ভবিষ্যতে আবুবকর (রাঃ)-এর ওপর আর কোন অত্যাচার না হয়। ইবনুল দাগানের একান্ত অনুরোধে আবুবকর (রাঃ) আবার মক্কায় প্রত্যাবর্তন করতে সম্মত হলেন। অতঃপর দুজনেই মক্কায় হাজির হলেন। একথা কিছুক্ষণের মধ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। ইবনুল দাগান সমস্ত কোরাইশ প্রধানকে ডাক দিলেন। সকলেই একত্রিত হল। আবুবকর (রাঃ)-ও হাজির থাকলেন। অতঃপর দাগান কোরাইশ প্রধানকে সম্বোধন করে বললেন, সমগ্র মক্কাতে এমন কে আছে, যে ব্যক্তি আবুবকর (রাঃ)-এর মতো মানুষের মহত্ত্বে ও সততায়, জ্ঞানে, বিচারে, সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, সহো-ধৈর্যে, মমতায়-সংযমতায়, ন্যায়ে ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ নয়। এরূপ একটি মানুষকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া সমগ্র মক্কাবাসীদের জন্যে সত্যিকারেরই ভীষণ লজ্জার কথা। আবুবকর আত্মীয়-স্বজনের প্রতি আপন জন, বন্ধু-বান্ধবদের অতীব নিকট ব্যক্তি, ধনীর পরামর্শদাতা, গরিবের পিতামাতা, অসহায়ের একান্ত আশ্রয়স্থল। এরূপ একটি তুলনাবিহীন মানুষ দেশ থেকে চলে যাওয়া দেশের পক্ষে কত দুর্ভাগ্যের কথা। এককথায় তিনি দেশের গৌরব। এরূপ একটি মানুষকে অত্যাচার করে দেশ থেকে বিতাড়িত করা মহা অন্যায়, মহা পাপ। বরং এই শ্রেণীর কোন মানুষ স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করতে চাইলেও দেশবাসীর উচিত তাঁকে সানুনয় অনুরোধ করেও আপন দেশে রাখা । অতঃপর সর্বশেষে ইবনুল দাগান কোরাইশদের মতামত জানতে চাইলেন। তাঁর দৃঢ়প্রত্যয় বক্তব্যে কোরাইশদের মন যেন বিগলিত হল। তারা কথা দিল, তারা আর কোনদিন কোন অত্যাচার করবে না। এই মীমাংসাতে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। কোরাইশগণের পক্ষ হতে বলা হল, আবুবকর আপন বাড়িতে নামাজ ও আল্লহর এবাদত বন্দেগি করবেন বাইরে প্রকাশ্যে কোথাও করবেন না, যাতে কোরাইশ ছেলেমেয়েগণ বিপথগামী না হয়ে যায়। এইরূপ করলে কোরাইশগণ আর কোনদিন আবুবকর (রাঃ)-এর ওপর কোন অত্যাচার করবে না। আবুবকর (রাঃ) মহানবীর পরামর্শমতো মক্কাতে থেকে গেলেন । এবং বাহির বাড়িতে একটি মসজিদ তৈরি করে আল্লাহর এবাদত ও কোরআন শরীফ তেলায়াৎ আরম্ভ করলেন। আবুবকর (রাঃ) এত সুললিত কণ্ঠে কোরআন পাঠ করতে পারতেন, যে কোন ব্যক্তি শুনলেই মোহিত ও মুগ্ধ না হয়ে পারত না। এইভাবে তাঁর কোরআন পাঠ শুনে বহু কোরাইশ ছেলেমেয়ের হৃদয় আন্দোলিত হয়ে উঠতে লাগল। তখন কোরাইশগণ বুঝতে পারল বিপদ দূরে নয়। এবার তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার ষড়যন্ত্র আরম্ভ করল এবং তারা আবুবকর (রাঃ)-কে জানিয়ে দিল, তাঁর এই আচরণে তারা তাদের দেওয়া কথা আর রক্ষা করতে পারবে না। এবার কোরাইশগণ সদলবলে ইবনুল দাগানের ঘরে গিয়ে হাজির হল। তারা তাঁকে অভিযুক্ত করল কেন তিনি এরূপ একটি মানুষকে মক্কায় আমাদের প্রতিবেশীত্ব দিলেন। যিনি আপন কথা রক্ষা করতে জানেন না। তখন ইবনুল দাগান সঙ্গে সঙ্গে আবুবকর (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কোরাইশদের আনা অভিযোগগুলো তুললে তিনি কালবিলম্ব না করেই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, আবুবকর (রাঃ) জীবনে কথা ভঙ্গ করেন না, মানুষকে কোনদিনই কষ্ট দেন না। শঠতা, ষড়যন্ত্র কি জিনিস তিনি তাও কোনদিনই জানেন না। মানুষের উপকার ও হিতসাধন করাই তাঁর জীবনের মহান ব্রত। এই কথাগুলো আমার নয়, এই কথাগুলো আপনারই, আপনিই এই সেদিন মাত্র আমার সম্পর্কে এই কথাগুলোই কোরাইশ প্রধানদের সম্মুখে সজোরে উচ্চারণ করেছিলেন । এখন যদি আপনার অসুবিধা হয় আমাকে প্রতিবেশীত্ব দিতে, আমাকে সাহায্য করতে, আমার বন্ধু হতে, তাহলে আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি আপনার দেওয়া সমস্ত জিনিস প্রত্যাহার করে নিন। কেননা আমি জানি-
(১) কাফা বিল্লাহেশাহিদান, আল্লাহ্ আমার চলার পথে সাক্ষী রূপে যথেষ্ট ।
(২) কাফা বিল্লাহে ওলিয়ান, আল্লাহ্ আমার অবিভাবক রূপে যথেষ্ট ।
(৩) কাফা বিল্লাহে নাসিরান, আল্লাহ্ সাহায্যকারী রূপে যথেষ্ট। (৪) কাফা বিল্লাহে ওয়াকিলান, আল্লাহ্ আমার কার্য সম্পাদনকারী রূপে যথেষ্ট। অর্থাৎ আমি আপনার দেওয়া সমস্ত কিছু ফেরত দিলাম ও এক আল্লাহর ওপর ভরসা করলাম। যে জন নির্ভর করে একের ‘পরে তিনিই যথেষ্ট জানি তাহার তরে, এরপর আবুবকর (রাঃ) কোরাইশদের পরম শত্রুতে পরিণত হলেন। আবুবকর (রাঃ)-এর মনোবাঞ্ছা আল্লাহই পরিপূর্ণ করলেন। কেননা আবুবকর (রাঃ) একদিনের জন্যে মহানবীকে ত্যাগ করতে চাননি। পরিস্থিতি ও পরিবেশ তাঁকে বাধ্য করেছিল মক্কা ত্যাগে। কিন্তু তাঁর মন পড়েছিল মহানবীর নিকট। তাই আজ আমরা দেখলাম আবুবকর (রাঃ)-এর মনের জোর, ইচ্ছার জয়। আজ তিনি আবার মহানবীর পাশে। আজ তাঁর আনন্দের সীমা নেই। দুঃখ-শোক- তাপ-যন্ত্রণা, অত্যাচার-অবিচার, ষড়যন্ত্র সবকিছুই চলছিল, কিন্তু কোন কিছুই তাঁর মনোবলকে ভাঙতে পারেনি। তিনি একেবারেই দৃঢ় ছিলেন পাহাড়ের ন্যায়, প্রশান্ত ছিলেন মহা সাগরের ন্যায় মহানবীর পাশে। এখন আবার মহানবী ও আবুবকর (রাঃ) সুখে-দুঃখে, চরম বিপদে পাশাপাশি। এই সময় অত্যাচার সীমা অতিক্রম করল। এককথায় মহানবী ও আবুবকর (রাঃ)-এর এই অত্যাচারের চোটে দেওয়ালে যেন পিঠ ঠেকে গেল।