গুহার মধ্যে মহানবী (সঃ) এবং হযরত আবুবকর (রাঃ)
গুহার মধ্যে মহানবী (সঃ) এবং হযরত আবুবকর (রাঃ)
মহানবীর মক্কা জীবনের চরম পরিণতি এগিয়ে এল। মক্কার কোরাইশ-কুল একেবারেই তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে মহানবীকে নিয়ে। তারা আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় মহানবী মক্কাতে থাকবেন, কিংবা কোরাইশকুল সগৌরবে থাকবেন। সমস্ত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আজ শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু মাত্র বাকি সিদ্ধান্ত নিতে। অত্যাচারের এমন কোন অধ্যায় আর বাকি নেই, যাকে আবার প্রয়োগ করা যায়, আজ সকল কোরাইশ সন্তানই যেন একমত-একটা কিছু কর। যা সকল অশান্তির চির যবনিকা টেনে দেবে। সকলেই এক একটি পরামর্শ দিল। কিন্তু কোনটাই টিকল না। অবশেষে টিকল আবু জেহলের প্রখ্যাত প্রস্তাব, চৌদ্দ গোত্রের চৌদ্দজন বীর একত্রিত হোক মহানবীর দরজায় । প্রভাত-কালে মহানবী নামাজ পড়তে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঐ চোদ্দজন বীর যুবকের চৌদ্দটি বিশাল আরবী তরবারি এক সাথে মহানবীর নশ্বর শরীরকে নিমিষে চৌদ্দ খণ্ড করে দেবে। এই প্রস্তাবটিই সকলের নিকট সাদরে গৃহীত হল। ইতিমধ্যে পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ানক ভেবে আল্লাহর নবী তাঁর লোকদের একের পর এক ইয়াসরেবে (মদিনায়) পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মক্কাতে তেমন আর কেউ ছিল না বললেই চলে, শুধুমাত্র আবুবকর (রাঃ) ব্যতীত। আল্লাহর নবী আল্লাহরই নির্দেশের অপেক্ষায় মাত্র ছিলেন। আল্লাহ্ও যেন অপেক্ষা করছিলেন কোরাইশগণ কতদূর আগাতে পারে । পাপ ও পুণ্যের লীলা দেখ সব ঘেরি’ সবেরে সময় দিয়ে কর কিছু দেরি । এবার মহান আল্লাহ্ তাঁর নবীকে জানিয়ে দিলেন কোরাইশদের গোপন কথা, সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিলেন মক্কা ত্যাগ করে মদিনা যেতে। মহানবী সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত হলেন মদিনার পথে যাত্রা করার জন্যে । একথা কেউই জানত না, একমাত্র আবুবকর (রাঃ) ব্যতীত। মহানবী তাকে এ আশ্বাসও দিয়েছিলেন, হয়তো তুমি আমার সাথে থাকবে। আবুবকর (রাঃ) এ কথা শুনে যেন আনন্দে আত্মহারা। মহাকাল, মহাক্ষণ, মহারাত্রি ঘনিয়ে এল। মহানবী তাঁর শয্যাতে তরুণ আলীকে ঘুমাবার যথাযথ নির্দেশ দিয়ে প্রস্থানের জন্যে প্রস্তুত হলেন। হেনকালে আবুবকর (রাঃ) মহানবীকে সঙ্গে নিয়ে নিজ বাড়ির দিকে রওনা হলেন। অথচ মহানবীর দরজায় ১৪ জন বীর যুবক অতন্দ্র প্রহরী নিযুক্ত। পথিমধ্যে মাঝে মাঝে কোরাইশদের জটলা। এরই মাঝে আবুবকর (রাঃ) মহানবীকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। পথিমধ্যে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করল কে? আবুবকর (রাঃ) উত্তর দিলেন, আমি আবুবকর (রাঃ)। আবার প্রশ্ন, তোমার সঙ্গে কে? উত্তরে আবুবকর (রাঃ) ‘মোহাম্মদ (সাঃ)। কোরাইশ কুল হো হো করে হেসে উঠল । তারা ভেবেছিল আবুবকর (রাঃ) তাদের উপহাস করছে; কেননা যে মানুষটিকে হত্যার জন্যে আজ সমস্ত মক্কাবাসী একত্রিত ও একমত, তাঁকে প্রকাশ্যে নিয়ে যায় কোন সাহা। এ হাদিস বর্ণনাকারী এই রূপ বর্ণনা আবার এই ঘটনা সম্পর্কে স্বয়ং কোরাভাবে লক্ষ্য করি “আমি এদের সামে ও পেছনে অন্তরাল স্থাপন করেছি, এবং ওদের দৃষ্টির ওপর আবরণ রেখেছি, ফলে ওরা দেখতে পায় না।” সূরা ইয়াসীন এখানে দেখা যাচ্ছে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্, যিনি মানুষকে প্রবণশক্তি, দর্শনশক্তি বা যাবতীয় শক্তি দিয়েছেন, তিনি যে কোন মুহূর্তেই যে কোন শক্তিকেই কেড়ে নিতে পারেন। এইভাবেই তিনি তাঁর নবীনী সাহায্য করলেন। হয়তো কেউ কেউ বলবেন সমগ্র মদিনার পথে এই সাহায্য তো দেখি না। কথাটা ঠিকই। আল্লাহ্ তাঁর নবীগণকে তখনই সাহায্য করেছেন, যখন প্রয়োজন মনে করেছেন। যাই হোক মহানবী আবুবকর (রাঃ)-এর সাথে তাঁর বাড়িতে পৌঁছালেন। যেখানে তখন হাজির ছিল আবুবকর (রাঃ)-এর পুত্র আব্দুল্লাহ, কন্যা আসমা ও আয়েশা। কন্যা আসমা তাঁদের জন্যে কিছু খাবার প্রস্তুত করে দিলেন। মহানবী পূর্বেই ঠিক করেছিলেন কিছু সময় মক্কার বাইরে গোপনে থাকবেন। যাতে মক্কার কোরাইশকুল সঙ্গে সঙ্গে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে তাঁদের বিপদে ফেলতে না পারে। তাই করলেন মক্কার অদূরে সত্তর পাহাড়। এই পাহাড়ের মধ্যে দু’জনে গোপনে আশ্রয় নিলেন। আবুবকর (রাঃ) প্রথম গুহার মধ্যে ঢুকে দেখে নিলেন। অতঃপর মহানবীকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। তিনি তাঁদের বিদায়বেলায় পুত্র ও কন্যাদের নির্দেশ দিয়ে এসেছিলেন তারা কিভাবে গোপনে রাত্রিকালে মহানবী ও পিতাকে খাবার দিয়ে আসবে। তারা তিনদিন ও তিন রাত এই নির্দেশ পালন করেছিল। এদিকে সকালবেলায় কোরাইশকুল হতবাক, হতভজ্ঞ। নেই মহানবী, নেই অনুচর আবুবকর (রাঃ)। বিছানাতে আলী (রাঃ) একি দৃশ্য। মহানবী কোথায় গেলেন, কেমন করে গেলেন। সারা মক্কাতে হৈ হৈ রব পড়ে গেল। নিষ্ঠুর আবুজেহেল আবুবকর (রাঃ)-এর বাড়িতে গিয়ে কন্যা আসমাকে জিজ্ঞেস করায় কোন মনোমত উত্তর না পেয়ে বালিকার গালে সজোরে চপেটাঘাত দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মক্কাতে ঘোষণা করা হলো যে কেউ মহানবীকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় হাজির করতে পারবে, তাকে একশো উট পুরস্কার দেওয়া হবে। এই পুরস্কারের লোভে ছোট বড় সকলেই মরিয়া হয়ে উঠল। এদিকে গুহা মধ্যে আবুবকর (রাঃ) ও মহানবী। মহানবী অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলেন। তাই আবুবকর (রাঃ)-এর কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আবুবকর (রাঃ) গুহা মধ্যে একটি গর্ত লক্ষ্য করে তাকে বন্ধ করার জন্যে কিছু হাতের কাছে না পেয়ে নিজ পা দ্বারাই বন্ধ করলেন যাতে মহানবীর কোন বিপদ না ঘটে। কিন্তু ঐ গর্তে ছিল বিষধর সর্প, সে আবুবকর (রাঃ)-এর পায়ে কামড় দেওয়ায়, আবুবকর (রাঃ) ভীষণ যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকেন। এমনকি আবুবকর (রাঃ)-এর চক্ষু দিয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তে থাকে। হঠাৎ কয়েক বিন্দু অশ্রু মহানবীর শরীরে পড়ায় তৎক্ষণাৎ তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখের লালা লাগিয়ে দিলেন। যন্ত্রণা উপশম হল। কিছুক্ষণের মধ্যে গুহামুখে বন্য বড় মাকড়সা ডালপালার ওপর একটা জাল বুনে দিল। অতঃপর বন্য কবুতর ঐ জালকে নিরাপদ বাসা ভেবে ডিম পাড়ে, ও তা’ দিতে থাকে। সকালে কোরাইশগণ আকাশ-পাতাল তোলপাড় করে তোলে, মহানবী ও আবুবকর (রাঃ)-এর খোঁজে। সত্তর পাহাড়ের চারদিকে লোক ঘুরতে থাকে, কোথায় তাঁরা! কয়েকজন গুহার দ্বারে হাজির হয়ে দেখল, দ্বারে কবুতরের বাসা, ডিম ইত্যাদি। বুঝে নিল এখানে কেউই নেই। কিন্তু গুহা মধ্যে দু’জন। বাইরের লোকের কোলাহল ও কলরবে আবুবকর (রাঃ) অত্যন্ত ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কোন কোন সময় তাদেরকে লক্ষ্যও করছিলেন অতি ক্ষীণভাবে। মহানবীর জন্যে চিন্তায়, ভাবনায়, আবুবকর (রাঃ) একেবারেই যেন বিহ্বল হয়ে পড়লেন। তখন মহানবী তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন, তুমি চিন্তা করো না, আল্লাহ্ আমাদের সাথে আছেন । আজ আবুবকর (রাঃ) ধন্য হলেন, তাঁকে উল্লেখ করেই কোরআন অবতীর্ণ হলো, “যখন অবিশ্বাসীরা তাকে বহিষ্কৃত করেছিল; এবং সে ছিল দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয়, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিল; তখন সে স্বীয় সঙ্গীকে (আবুবকর (রাঃ)-কে) বলেছিল, তুমি চিন্তা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গে আছেন। সূরা তওবা এইভাবে তিনদিন তিন রাত্রি কেটে গেল। আবুবকরের পুত্র আব্দুল্লাহ ও ভৃত্য আমরও তাঁদের সাথে যোগদান করলেন। আবুবকর (রাঃ) পূর্ব হতেই তিনটি উটকে প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পুত্র ও ভৃত্য প্রতিরাত্রে অত্যন্ত গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করতে ।